কোমরে বা পিঠের নিচের দিকে ব্যথা অনুভব করা একটি খুবই সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই ধরনের ব্যথায় ভোগেন। তবে, এই ব্যথা যখন তীব্র হয় বা সাধারণ চিকিৎসার পরেও না সারে, তখন মনে একটি বড় প্রশ্ন আসে, এটা কি স্রেফ পেশীর টান জনিত কোমর ব্যথা ও কিডনি ব্যথার পার্থক্য বুঝতে না পারার ফল, নাকি কোনো গুরুতর কিডনি সমস্যার লক্ষণ? আমাদের এক জোড়া কিডনি মেরুদণ্ডের নিচের দিকে, পাঁজরের ঠিক নিচে অবস্থিত হওয়ায়, প্রায়শই কিডনির ব্যথা এবং সাধারণ কোমর ব্যথাকে এক বলে ভুল করা হয়।
সঠিক চিকিৎসা শুরু করার জন্য এটি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি। কিডনিজনিত সমস্যা জীবন বিপন্নকারী হতে পারে, তাই লক্ষণগুলো চিনে নেওয়া অপরিহার্য। এই বিস্তৃত নির্দেশিকায় আমরা বিশদভাবে আলোচনা করব, কীভাবে আপনি এই দুটি ভিন্ন ব্যথার উৎস এবং প্রকৃতির মধ্যে মূল কোমর ব্যথা ও কিডনি ব্যথার পার্থক্য সহজে চিহ্নিত করতে পারবেন।
কোমর ব্যথা কী?
কোমর ব্যথা, যা ইংরেজিতে লোয়ার ব্যাক পেইন বলা হয়, সাধারণত পিঠের নিচের অংশে অনুভূত হয়। এটি মাংসপেশী, লিগামেন্ট বা মেরুদণ্ডের সমস্যা থেকে উদ্ভূত হয়। অনেকের জীবনে কোনো না কোনো সময় এই ব্যথা হয়, যা দৈনন্দিন কাজকর্মে বাধা সৃষ্টি করে। কিন্তু কোমর ব্যথা ও কিডনি ব্যথার পার্থক্য বোঝা খুবই জরুরি, কারণ কোমর ব্যথা প্রায়শই মেকানিক্যাল কারণে হয়, যেমন ভারী জিনিস তোলা বা খারাপ ভঙ্গিমা। এই ব্যথা সাধারণত নিচের পিঠে কেন্দ্রীভূত থাকে এবং চলাফেরা করলে আরও বাড়তে পারে।
কোমর ব্যথার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে মাংসপেশীর টান, ডিস্ক হার্নিয়া, আর্থ্রাইটিস বা এমনকি স্ট্রেস। এটি দীর্ঘস্থায়ী হলে জীবনযাত্রার মান কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ, অফিসে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে কোমরে ব্যথা হওয়া সাধারণ। এখানে কোমর ব্যথা ও কিডনি ব্যথার পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে, কারণ কোমর ব্যথা প্রায়শই শারীরিক ক্রিয়াকলাপের সাথে যুক্ত।
কিডনি ব্যথা কী?
কিডনি ব্যথা হলো কিডনির সমস্যা থেকে উদ্ভূত ব্যথা, যা সাধারণত পিঠের উপরের অংশে, পাঁজরের নিচে অনুভূত হয়। কিডনি আমাদের শরীরের ফিল্টার হিসেবে কাজ করে, এবং যখন এতে সমস্যা হয় তখন ব্যথা হয়। এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ কিডনি ব্যথা প্রায়শই ইনফেকশন, পাথর বা অন্যান্য রোগের লক্ষণ। এই ব্যথা সাধারণত একপাশে হয় এবং তীব্র হতে পারে।
কিডনির অবস্থান পিঠের পিছনে, পাঁজরের নিচে হওয়ায় অনেকে এটিকে কোমর ব্যথা ভেবে ভুল করেন। কিন্তু বোঝার জন্য আমাদের লক্ষণগুলো দেখতে হবে। কিডনি ব্যথা প্রায়শই বমি, জ্বর বা প্রস্রাবের সমস্যার সাথে যুক্ত। এটি হঠাৎ করে শুরু হতে পারে এবং চলাফেরা করলে পরিবর্তন হয় না।
কোমর ব্যথা ও কিডনি ব্যথার পার্থক্য
১. ব্যথার অবস্থান
ব্যথা ঠিক কোন জায়গায় হচ্ছে, এটিই হলো কোমর ব্যথা ও কিডনি ব্যথার পার্থক্য বোঝার প্রথম ধাপ।
কিডনি ব্যথার অবস্থান
কিডনিগুলো মেরুদণ্ডের দুপাশে, পেটের ভেতরের দিকে বেশ গভীরে থাকে। এগুলি সাধারণত শেষ পাঁজরের হাড়ের ঠিক নিচে (T12 থেকে L3 কশেরুকার স্তর পর্যন্ত) অবস্থিত। তাই কিডনিজনিত ব্যথা সাধারণত:
- গভীর এবং উচ্চতর: এটি পিঠের উপরের দিকে বা মাঝখানে, পাঁজরার নিচে অনুভূত হয়।
- পার্শ্বের দিকে: ব্যথা সাধারণত মেরুদণ্ড থেকে দূরে, ডান বা বাম পাশে (Flank Region) হয়, যেখানে কিডনি রয়েছে।
- ছড়িয়ে যাওয়া: ব্যথা অনেক সময় পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে শুরু হয়ে কুঁচকির দিকে, তলপেটে বা উরুর ভেতরের দিকে ছড়িয়ে যেতে পারে।
কোমর ব্যথার অবস্থান
অন্যদিকে, সাধারণ কোমর ব্যথা (Lower Back Pain) বা পেশীর টান জনিত ব্যথা সাধারণত:
- নিচে এবং মধ্যভাগে: এটি নিতম্বের ঠিক ওপরে মেরুদণ্ডের কাছাকাছি অংশে কেন্দ্রীভূত হয়।
- নির্দিষ্ট এলাকা: পেশী বা মেরুদণ্ডের ব্যথার ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে বা ছোট এলাকায় ব্যথা অনুভূত হয়।
- পায়ে ছড়ানো (Sciatica): মেরুদণ্ডের ডিস্ক বা স্নায়ুতে সমস্যা হলে ব্যথা নিতম্ব থেকে পা পর্যন্ত (Sciatica) ছড়িয়ে যেতে পারে, যা কিডনি ব্যথার ক্ষেত্রে প্রায় হয় না। এই ছড়িয়ে যাওয়ার ধরন দেখে আপনি কোমর ব্যথা ও কিডনি ব্যথার পার্থক্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন।
২. ব্যথার প্রকৃতি ও তীব্রতা
ব্যথা কীভাবে অনুভূত হচ্ছে, তা দুটি সমস্যার মধ্যে মূল কোমর ব্যথা ও কিডনি ব্যথার পার্থক্য বুঝতে সাহায্য করে।
কিডনি ব্যথার প্রকৃতি
কিডনিজনিত ব্যথা মূলত দু’রকমের হতে পারে:
- ধ্রুবক ভোঁতা ব্যথা (Dull Ache): যদি কিডনিতে সংক্রমণ (Infection) বা প্রদাহ (Inflammation) হয়, তবে রোগী একটি স্থির, গভীর এবং ভোঁতা ব্যথা অনুভব করেন, যা দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে।
- তীব্র ধারালো ব্যথা (Colicky Pain): যদি কিডনি পাথর (Kidney Stones) মূত্রনালীর মধ্য দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, তখন অত্যন্ত তীব্র, ছুরির কোঁচানোর মতো ধারালো ব্যথা হয়। এই ব্যথা আসে এবং যায়, অনেকটা ঢেউয়ের মতো (Waves of pain)। কিডনি ব্যথার ক্ষেত্রে শরীরের ভঙ্গি বা অবস্থান পরিবর্তন করলেও ব্যথার উপশম হয় না। এটি একটি স্পষ্ট কোমর ব্যথা ও কিডনি ব্যথার পার্থক্য।
কোমর ব্যথার প্রকৃতি
পেশী, লিগামেন্ট বা হাড়ের কারণে সৃষ্ট কোমর ব্যথা সাধারণত:
- পজিশনাল (Positional): এই ব্যথা নড়াচড়া, বাঁকানো, হাঁটা বা দীর্ঘ সময় বসে থাকার মতো নির্দিষ্ট কার্যকলাপের দ্বারা খারাপ হয় বা ভালো হয়।
- গতিশীলতা: কিছু নির্দিষ্ট অবস্থান বা বিশ্রামে গেলে ব্যথা কমে যায়।
- ধরন: অনেকে এই ব্যথাকে টান ধরা, তীব্র খোঁচা মারা, জ্বালাপোড়া বা অসাড়তা হিসেবে বর্ণনা করেন।
৩. সহযোগী উপসর্গ
সাধারণ কোমর ব্যথার সঙ্গে সাধারণত কোনো অতিরিক্ত শারীরিক সমস্যা থাকে না। কিন্তু কিডনি ব্যথার সঙ্গে কিছু সুনির্দিষ্ট উপসর্গ দেখা দেয়, যা এই দুটি সমস্যার মধ্যে কোমর ব্যথা ও কিডনি ব্যথার পার্থক্য নির্ণয়ে সিদ্ধান্তমূলক ভূমিকা পালন করে।
| উপসর্গ | কিডনি সমস্যাজনিত ব্যথা | সাধারণ কোমর ব্যথা |
| প্রস্রাবের পরিবর্তন | উপস্থিত। প্রস্রাবের সময় জ্বালা (Dysuria), ঘন ঘন প্রস্রাব, প্রস্রাবে রক্ত (Hematuria), ফেনা বা দুর্গন্ধযুক্ত প্রস্রাব। | অনুপস্থিত। |
| জ্বর ও ঠান্ডা লাগা | উপস্থিত। কিডনি সংক্রমণ (Pyelonephritis) একটি গুরুতর অবস্থা, যেখানে উচ্চ জ্বর ও কাঁপুনি হতে পারে। | অনুপস্থিত। (স্পাইনাল টিউমার বা ক্যানসার ছাড়া) |
| বমি বমি ভাব/বমি | উপস্থিত। কিডনিজনিত তীব্র ব্যথার ক্ষেত্রে বমি হওয়া বা বমি বমি ভাব হওয়া খুব সাধারণ। এটি স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে কিডনি ও পাকস্থলীর সংযোগের কারণে ঘটে। | অনুপস্থিত। |
| অসুস্থতা ও ক্লান্তি | উপস্থিত। কিডনি সমস্যায় শরীর দুর্বল ও অসুস্থ লাগে। | অনুপস্থিত। |

৪. কারণের ভিত্তিতে কোমর ব্যথা ও কিডনি ব্যথার পার্থক্য
কোমর ব্যথার মূল কারণ
বেশিরভাগ কোমর ব্যথা হয় যান্ত্রিক বা পেশীজনিত কারণে:
- পেশীর টান (Muscle Strain): অতিরিক্ত ব্যায়াম বা ভারী জিনিস তোলার ফলে পিঠের পেশী বা লিগামেন্টের ক্ষতি।
- ভুল অঙ্গবিন্যাস (Poor Posture): দীর্ঘ সময় ধরে ভুল ভঙ্গিতে বসা বা দাঁড়ানো।
- ডিস্ক প্রোল্যাপস (Herniated Disc): মেরুদণ্ডের দুটি কশেরুকার মধ্যবর্তী ডিস্ক স্থানচ্যুত হয়ে স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি।
- বাত (Arthritis): মেরুদণ্ডের হাড়ের সন্ধিতে ক্ষয়।
কিডনি ব্যথার মূল কারণ
কিডনিজনিত ব্যথা মূলত এই অঙ্গটির কার্যকারিতার সঙ্গে জড়িত:
- কিডনি পাথর (Nephrolithiasis): মূত্রনালীতে পাথর তৈরি হওয়া, যা তীব্র ব্যথা সৃষ্টি করে।
- কিডনি সংক্রমণ (Pyelonephritis): মূত্রথলি থেকে সংক্রমণ কিডনিতে ছড়িয়ে পড়া।
- পলিসিস্টিক কিডনি রোগ (PKD): কিডনিতে সিস্ট বা থলির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি।
- রক্ত জমাট বাঁধা বা আঘাত: কিডনিতে আঘাত বা রক্তনালীর সমস্যা।
৫. রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা
আপনি যদি ব্যথার পার্থক্য নিজে থেকে করতে না পারেন, তখন চিকিৎসকের কাছে যাওয়া আবশ্যক। চিকিৎসক বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে ব্যথার উৎস চিহ্নিত করেন।
চিকিৎসক কী করবেন?
১. শারীরিক পরীক্ষা: ডাক্তার সাধারণত পেছনের পাঁজরার নিচের নরম স্থানে (Costovertebral Angle) আলতো চাপ দেন বা টোকা মারেন। যদি এতে তীব্র ব্যথা হয়, তবে এটি কিডনি সমস্যা। (CVA Tenderness)
২. মূত্র পরীক্ষা (Urinalysis): কিডনি সমস্যা থাকলে প্রস্রাবে রক্ত, শ্বেতকণিকা (White Blood Cells) বা ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি ধরা পড়ে।
৩. রক্ত পরীক্ষা: রক্তে ক্রিয়েটিনিন বা ইউরিয়ার মাত্রা পরীক্ষা করে কিডনির কার্যকারিতা বোঝা যায়।
৪. ইমেজিং পরীক্ষা: আল্ট্রাসনোগ্রাফি, সিটি স্ক্যান বা এক্স-রে ব্যবহার করে কিডনি পাথর, সিস্ট বা অন্যান্য কাঠামোগত অস্বাভাবিকতা সনাক্ত করা হয়।
চিকিৎসা পদ্ধতির পার্থক্য
- কিডনি ব্যথার চিকিৎসা: কারণের ওপর নির্ভর করে। সংক্রমণে অ্যান্টিবায়োটিক, পাথরের জন্য এবং প্রয়োজনে সার্জারি বা লিথোট্রিপসি।
- কোমর ব্যথার চিকিৎসা: বিশ্রাম, ফিজিওথেরাপি, ব্যথা উপশমকারী ওষুধ এবং কিছু ক্ষেত্রে জীবনযাত্রার পরিবর্তন বা সার্জারি।
গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা (কোমর ব্যথা ও কিডনি ব্যথার পার্থক্য)
যদি আপনার পিঠে বা কোমরে ব্যথার সঙ্গে জ্বর, প্রস্রাবে রক্ত, প্রস্রাব করতে না পারা বা তীব্র বমি বমি ভাব থাকে, তবে এটিকে সাধারণ কোমর ব্যথা ও কিডনি ব্যথার পার্থক্য জনিত ভুল না ভেবে, জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে যান। কিডনি রোগ দ্রুত খারাপের দিকে যেতে পারে এবং জীবন ঝুঁকির কারণ হতে পারে।
শেষ কথা
সাধারণ কোমর ব্যথা জীবনের একটি অংশ হতে পারে, কিন্তু কিডনি ব্যথা একটি বিপদ সংকেত। এই ব্লগের মাধ্যমে আমরা কোমর ব্যথা ও কিডনি ব্যথার পার্থক্য সম্পর্কে বিশদ তথ্য দিয়েছি। ব্যথার অবস্থান, প্রকৃতি এবং সহযোগী উপসর্গগুলি মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলে আপনি নিজেই প্রাথমিক ধারণা তৈরি করতে পারবেন। তবে মনে রাখবেন, চূড়ান্ত রোগ নির্ণয় এবং সঠিক চিকিৎসার জন্য সর্বদা একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন থাকুন এবং এই দুটি ব্যথার পার্থক্য সঠিকভাবে জানুন।
অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য উত্তরা বা বনানী শাখায় সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টার মধ্যে +8801774678604 নম্বরে যোগাযোগ করুন।
আমাদের ফেইসবুক পেইজঃ পেইন কিউর
বিস্তারিত জানুন: গর্ভাবস্থায় কোমর ব্যথার কারণ এবং এটি হলে করণীয় কি?
বিস্তারিত জানুন: কিডনির সমস্যা হলে কোথায় কোথায় ব্যথা হয় এবং কি করতে হবে?
বিস্তারিত জানুন: সহবাসের পর কোমর ব্যথা এবং সহবাসের পর ব্যথা হলে করণীয় কি?

Dr. Saiful Islam, PT, is a Consultant Physiotherapist with expertise in Orthopedics. He holds a BPT from Dhaka University, an MPT, and a Postgraduate Certification in Acupuncture from India, with specialized training in Ozone Therapy.




